মাশুদুল হক

পারফেক্ট কেক

একটা বেকারি শপ থেকে কেক অর্ডার করলাম। শপের নামই পারফেক্ট কেক। খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী নাম।

ওদের দাবি অনুযায়ী ওদের মত নিঁখুত কেক কেউ তৈরি করতে পারেনা। আমি ওদের ওয়েবসাইটে গিয়ে কিছু কেক দেখে সত্যি অবাক হলাম। ওদের বিশেষত্ব হচ্ছে ওরা যেকোন মানুষ বা প্রাণীর মত দেখতে হুবহু কেক বানাতে পারে। যতটা না কেক তারচেয়ে বেশি আর্ট, একেকটা যেন যাল পারানের মত কোন হাইপার রিয়েলিজম আর্টিস্টের কাজ।

আমি কেক খুঁজছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ডের জন্য। দুই সপ্তাহ পর ওর জন্মদিন। আমি ইনবক্সে ওদের নক করে আমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি পাঠালাম।

ওরা খানিকবাদে আমার হলোফোনে কল দিল। একজন ধবধবে সাদা অ্যাপ্রন আর ক্যাপ পড়া অল্পবয়েসী মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কতটা নিঁখুত চাই।

আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, কতটা নিঁখুত সম্ভব।

শত ভাগ।

আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, শত ভাগ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

মেয়েটা মুখ শক্ত করে বলল, শত ভাগই সম্ভব। তবে সে জন্য আপনার বয়ফ্রেন্ডের জিনোমিক প্রফাইল শেয়ার করতে হবে। আর খরচ হবে বিশ হাজার ক্রেডিট।

আমি একটু থমকে গেলাম। পয়সা আমার কাছে সমস্যা না, সেটা ওরাও জানে-তাই হয়তো এই প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু জিনোমিক প্রফাইল শেয়ার করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।

এ ব্যাপারে আমি আমার দু:শ্চিন্তা প্রকাশ করলাম। মেয়েটি হাসি মুখে আমাকে অভয় দিল, আপনি নিশ্চিত থাকুন ম্যাম, কেক বানানোর পরপরই আমরা সেটা মুছে ফেলবো সিস্টেম থেকে। আমরা গোল্ডেন গ্রেডেড কোম্পানী, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই লাইসেন্স থাকলে সে কোম্পানি কতটা নিরাপদ। আপনার বা আপনার বয়ফ্রেন্ডের কোন সিকিউরিটি রিস্ক নেই।

গোল্ডেন গ্রেডেড সেটা আমি দেখেছি। দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছি সত্যি। সাধারণত ঔষধ কোম্পানিদের এই লাইসেন্স থাকে।

আমি রাজি হয়ে অর্ডার দিয়ে ফেললাম।

দুই সপ্তাহ পরে ওরা সন্ধ্যার দিকে কেকটা দিয়ে গেল ওরা, আমি ইতিমধ্যে ভুলে গেছিলাম এই অর্ডারের কথা, ওরা অবশ্য বলেছিল হাইপার রিয়েলিস্টিক কেক করতে ওদের এমন সময় লাগে।

তাই প্যাকেটা খুলে আমি আঁতকে উঠলাম, প্রায় চিৎকার দিয়ে ফেলেছি।

প্যাকেটটা খুলতেই দেখি একটা মানুষের মাথা, কেউ যত্ন করে গলা থেকে কেটে নিয়ে প্যাকেট করে পাঠিয়েছে। মাথাটা আর কারো নয়, জিমের। আমি এতটাই বিচলিত হলাম যে সাথে সাথে জিমকে কল করলাম জানতে যে সে ঠিক আছে কিনা। জিম আমার দুঃশ্চিন্তায় মজাই পেল। ও সাথে সাথে বাড়ি চলে এল ওর কাজ রেখে। জিম সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার ইন্সপেক্টর, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। ও এমন চট করে আগেই চলে আসবে ভাবতে পারিনি।

দেখাও দেখি তোমার কেক। ও হেসে বলল।

কেকটা দেখে জিমও ভড়কালো মনে হল। তবে সহজে প্রকাশ করলো না। হেসে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলো। আমার নিজের মাথারও একটা অর্ডার করা উচিত ছিল এবং তাতে যে ব্যাপারটা আরো দুর্দান্ত হত এসব বলল।

ওটা টেবিলে রেখে আশপাশ থেকে দেখতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে। দৃশ্যটা অদ্ভুত, মনে হচ্ছে একজন মানুষ তার নিজের কাটা মাথাটা পর্যবেক্ষণ করছে, এর মধ্যে একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার আছে।

জিম শেষমেশ বলল, অসাধারণ কাজ। চলো এটাকে কাটি।

আমি আপত্তি করলাম। এটা কাটার দরকার নেই। দেখেই আমার ভয় লাগছে।

জিম আমার কথায় উচ্চস্বরে হাসলো, আমি ছেলেমানুষী করলে যেভাবে হাসে।

না কাটলে আর কেক কেন? কেটে খেয়ে ফেলতে হবে এটাই নিয়ম। হাহা।

উহু, এখনকার বেকারি গুলো খাওয়ার জন্য আর কেক বানায় না। এটা খেতে নিশ্চয়ই খুব বিশ্রী হবে।

জিম মুখে বাঁকা হাসি ধরে রেখে বলল, কখনোই না, আমি খেতে মোটেও বিশ্রী হতে পারি না।

তুমি খাওগে! আমি অন্তত খাচ্ছি না।

জিম এবার হাল ছাড়ার ভঙ্গি করে বলল, আচ্ছা অন্তত কাটতে হবে। না কাটলে তো কেকই হল না।

আমি তাতে রাজি হলাম, জিম রান্নাঘর থেকে বড় একটা কিচেন নাইফ নিয়ে আসে।

কাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো, কারন কেকটা প্রায় ঠান্ডায় জমানো। জিম ওর শক্তিশালী হাতে নাক থেকে কান বরাবর ধারালো ছুড়িটা চালালো। ছুড়িটা প্রথমে একটা আটকে গেলেও পরে দ্রত নাক থেকে মাথার পেছন পর্যন্ত চলে গেল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, চাপ চাপ লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে ওটা থেকে। একটা ছোট চাপা আর্তনাদ করে আমি পেছনে সরে এলাম।

জিমও প্রথমে ভড়কেছিলো, পরক্ষণে সামলে হেসে বলল, ওরা রক্তের মত লাল তরলও দিয়ে দিয়েছে রিয়েলিস্টিক বানাতে।

আমি আর দৃশ্যটা দেখতে পারলাম না।

ও বলল, নিজেই অর্ডার করে এখন নিজেই ঘাবড়াচ্ছো। চল এটাকে খাওয়া যাক।

‘এ জিনিস আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব? তুমি পাগল? তুমি খাও!’ আমি আগের সিদ্ধান্তে অনড় রইলাম।

জিম হেসে একটা টুকরো নিজের মুখে পুড়ে কামড় দিল। দৃশ্যটা বেশ অস্বাভাবিক লাগলো। মনে হল, ও নিজেই নিজের নাক আর চোখের একটা অংশ খেতে যাচ্ছে।

এমন সময় জিমের একটা ফোন এল। মুখে পোরা কেকটা প্লেটে রেখে বাইরে চলে গেল। ডিটেকটিভদের এই এক সমস্যা, কোন ফোনই আমার সামনে ধরবে না।

খানিক বাদে হাসিমুখে ফিরে বলল, পার্ফেক্ট কেক শপটার মূল কোম্পানির খোঁজ দিল আমার এক এজেন্ট, খানিক আগে আমি জানতে চেয়েছিলাম।

কি বলল?

বলল, ওদের নাকি আগে বায়োমেডিকেল লজিস্টিক সাপ্লায়ার কোম্পানি ছিল-যেটা কয়েকবছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। লস টস খেয়ে আরকি। সেখান থেকে বেকারি। চিন্তা করতে পারো নিজেদের ব্যবস্যা কিভাবে পরিবর্তন করেছে।

আমি একটা আশংকা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বায়োমেডিকেল লজিস্টিক সাপ্লায়ার মানে?

মানে অনেক কিছু, অন্যান্য দেশ থেকে মেডিসিন, ড্রাগ, মেডিকেল ডিভাইস ইত্যাদি এনে দিত। গত কয়েকবছর ধরে অবশ্য এসব অনেক কোম্পানিই বন্ধ হয়ে গেছে দেশে যখন ক্লোনিং বন্ধ হয়ে গেলো। ক্লোনিংয়ের সেটআপ ছিল ওদের ব্যবসার বড় একটা অংশ। মনে আছে, অনেকেই নিজেদের পোষা কুকুরের ক্লোন করা শুরু করেছিল।

শুনে আমাকে একটা অচেনা ভয় গ্রাস করলো। জিজ্ঞেস করলাম, হ্যা তখন খবরে দেখেছিলাম। ওরা নাকি অস্বাভাবিক দ্রুততায় কুকুরগুলোর ক্লোন করে দিতে পারতো, কয়েকমাসে?

হুম, এটাই সমস্যা ছিল। ওরা কোন বিশেষ গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করে করতো। সেটাও পরে নিষিদ্ধ হয়।

আমি সতর্কগলায় বললাম, ওরা কি মানুষের ক্লোনও করতো?

‘উহু, সেটা করতো না। তবে ওদের হাতে যে প্রযুক্তি ছিল, সেটা দিয়ে চাইলে করতে পারতো যে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।’

জিম কেকে আবার কামড় লাগায়। দৃশ্যটা দেখে আমার গা গুলিয়ে আসে!

তুমি ঠিকই বলেছো, কেকটা অত ভাল মনে হচ্ছে না, নোনতা নোনতা, মিষ্টির ছিঁটেফোটা নেই। তুমি নিশ্চয়ই সুগারফ্রি বলে দিয়েছো। কেক কি মিষ্টি ছাড়া ভাল লাগে?

আমি সুগারফ্রি অর্ডার করিনি সেটা সাবধানে চেপে গেলাম। ফোনটা চেক করে দেখলাম, পার্ফেক্ট কেক থেকে বেশ কয়েকটা কল। ওরা পাগলের মত কল দিচ্ছে কেন?

ওরা কি ভুল কিছু পাঠিয়ে দিল আমাকে।

আমি ফোনটা বন্ধ করে জিমকে জোর করে টেনে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়লাম। বললাম, এই কেক থাকুক, খেতে হবে না। চল বাইরে গিয়ে কিছু খাই।

জিম সহজেই রাজি হয়ে গেল। কেক থেকে মুক্তি পেয়ে খুশিই মনে হল।

বাইরে শেষ হেমন্তের চনমনে বাতাস আর ক্রিসেনথিমামের মনকাড়া সুবাস।

জন্মদিন পালনের জন্য দিনটা কি সুন্দর-ই না ছিল!

Masudul Haque

Masudul Haque is a contemporary writer from Bangladesh known for his works on thrillers, Sci-Fi, and children's literature. His works have been published in Bangladesh and India regularly for the last 12 years. He was awarded the Kali O Kalam Young Writer Award in 2013.

One thought on “পারফেক্ট কেক

  1. অন্যরকম একটা গল্প পড়লাম।
    শুরুটা ছিল নিরীহ, নাম শুনে ভাবলাম কেকময় হবে গল্পটা।
    কিন্তু যতই পড়তে থাকলাম, ততই শরীর কেঁপে উঠলো।
    কেকের ভেতর মানুষের মাথা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে!
    জিম চরিত্রটা যেন ভয়ের মাঝেও রহস্য বাড়িয়ে দিল।
    বর্ণনাগুলো এত বাস্তব যে মনে হচ্ছিল চোখের সামনে সব ঘটছে।
    ক্লোনিং আর বায়োটেকনোলজির টুইস্টটা সত্যিই মাথা ঘুরিয়ে দেয়ারমত।
    একটা কেক নিয়ে এতটা ভয়ংকর কিছু হতে পারে তা ভাবনায় আসেনি।
    শেষের হালকা সুবাস যেন দুঃস্বপ্নের পর হঠাৎ নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো।
    হরর, সাই-ফাই সাই-ফাই আবহাওয়া আর সাসপেন্স সব মিলিয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *