মাশুদুল হক

গল্প: সাইকোপ্যাথ

রাতের খাবার খাচ্ছিলাম এমন সময় নিউজটা দেখলাম। এক অপরাধী ধরা পড়েছে। পুলিশ নাকি অনেকদিন ধরে লোকটাকে খুঁজছিলো। টিভি বন্ধ করতে বাধ্য হলাম, কারন এ নিউজ বিস্তারিত দেখতে গেলে রাতের খাওয়াটা নষ্ট হবে।

মলি রান্নাঘরে ছিল। টিভি বন্ধ দেখে চোখ নাচিয়ে বলল, খুব মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছ দেখছি।

আমি হেসে ফেললাম। টিভি দেখে দেখে খাওয়া মলির খুব অপছন্দ, কিন্তু তাও আমাকে খুব একটা পরিবর্তন করাতে পারেনি।

আমি বললাম, হ্যাঁ। আজকের খাবারটা বেশ মজাদার হয়েছে। প্রোটিন কমিয়ে দিয়েছো?

হ্যাঁ, তাতো দিতেই হবে। খেতে একটু বিস্বাদ লাগছে?

আমি কিছু না বলে মুখের বাঁকা হাসিতে বুঝিয়ে দেই, কথা সত্য। ডাক্তার গতমাসে মানা করে দিয়েছে যাতে আগের মত প্রোটিন সর্বস্ব খাবার আর না খাই। তা না হলে নাকি কিডনি দুটো শীঘ্রই ঝামেলা পাকাবে।

‘শুনছো, এক সাইকোপ্যাথ নাকি ধরা পড়েছে?’ মলি খানিকবাদে খেতে খেতে বলল।

হ্যা, সে নিউজই দেখাচ্ছিলো টিভিতে। খাচ্ছি বলে দেখতে পারলাম না।

আশ্চর্য না, এমন ভয়ংকর মানুষও আছে!

হুম।

খাবার শেষে একটা ডকুমেন্টরি দেখবো চিন্তা করছিলাম, কিন্তু সবগুলো চ্যানেলে এমন ফলাও করে সাইকোপ্যাথটা নিউজ দেখাচ্ছে যে না দেখে পারলাম না। মলি বলল, হয়তো আমাদের আশে পাশে এমন আরো মানুষ আছে যারা এভাবে চিন্তা করে। সোসাইটির ভয়ে করতে সাহস পায় না।

ব্যাপারটা সত্যি হবার অতি ক্ষীণ সম্ভাবনাও আমাকে আতংকিত করলো। সন্ধ্যার বুলেটিনে রিপোর্টাররা লোকটার বাড়িতে গিয়ে রিপোর্ট করা শুরু করছেে। সে বাড়ির ভিতরটা দেখে মনে হল কোন অভিশপ্ত জায়গা। একটা রুমে ধারালো ছুড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা গ্যাস বার্নার, কয়েকটা বড়সড় ধাতব পাত্র। রিপোর্টার বলল, এসব পাত্রেই সে ভিকটিমদের রান্না করতো। তারপর এ বাড়িতে বসেই খেত, খাওয়া শেষে সমস্ত প্রমাণাদি বাড়ির পেছনের বার্নারে ছাই করে ফেলতো।

মলি বলল, লোকটার আশেপাশের বাড়িগুলোতে কেউ কোনদিন সন্দেহ করেনি?

মনে হয় বিচ্ছিন্ন কোন জায়গায় বাড়িটা। আর রিপোর্টার তো বলল, এখানে সে সবসময় থাকতো না। যখন কোন ভিকটিমকে ধরতে পারতো তখন নিয়ে আসতো।

কী বিভৎস ব্যাপার!

হুম। আজকে নিশ্চিতভাবে আমি দুঃস্বপ্ন দেখবো।

নিহান ঘুমিয়েছে? আমি মলিকে জিজ্ঞেস করি।

উম, জানি না। ছেলেটা মাঝেমধ্যে রাত জাগে। বলে পড়াশোনা আছে।

হ্যাঁ, ক্লাসের টপার সে কথা বললে তো আমাদের মানা উচিত।

হু, কিন্তু স্বাস্থ্য খারাপ হবে তো।

কিচ্ছু হবে না। এগুলো আধুনিক যুগের বাড়াবাড়ি। ছোটবেলা কত রাত জেগে পড়াশোনা করতাম।

পড়াশোনা করতে না প্রেম করতে?

তোমার অনুপ্রবেশের আগে তো পড়াশোনাই করতাম।

হ্যাঁ, তা তো বলবেই। থাক বাদ দিচ্ছি, পুরনো স্মৃতি আর ঘাঁটছি না।

হাহা, আচ্ছা ঘুমাও।

ক্লাস নিচ্ছিলাম। এমন সময় ডিপার্টমেন্টের ডিন বরিস ক্লাসরুমে উঁকি দিল।

ডক্টর এরিক, কিছু মনে করো না। এক মিনিটের জন্য বাইরে আসবে। বরিসের মুখে উদ্বেগের ছায়া মনে হল।

আমি বাইরে আসতেই বলল, মলিকে ফোন করো। আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে জানালো তোমাকে পাচ্ছে না।

আমি দ্রুত ফোন দেখলাম, সাইলেন্ট করা ছিল। দশটা কল। আমার পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। কী হল।

আমি বরিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাথে সাথে কল ব্যাক করলাম।

মলির কান্না জড়ানো গলায় আমার হৃৎপিন্ড যেন থেমে গেল, ও বলল, নিহানকে পাওয়া যাচ্ছে না এরিক। জলদি এসো।

আমি দ্রুত ড্রাইভ করে বাসার দিকে রওনা দেই। মলি এর মধ্যে পুলিশে ফোন দিয়েছে, তারপরও আমি আরেকবার ফোন দিলাম আমার পরিচিত এক অফিসারকে।

উনি জানালেন সার্চ টিম কাজ করছে।

নিহানের আজ স্কুল ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফেরার কথা। তিন দিনের ক্যাম্প। কাছেই একটা বনে ক্যাম্পিং করার জন্য গিয়েছিল টিচারসহ। আজ ফেরার দিন ওকে টিচাররা পাচ্ছে না।

বাসায় আসতেই মলিকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় পেলাম।

এরিক! চলো আমরা যাব।

আমি বললাম, অবশ্যই। কিন্তু তুমি বেশি ঘাবড়িও না। নিহান বুদ্ধিমান ছেলে। ও সহজে বিপদে পড়ার কথা না। হয়তো বনের ভিতরে পথ হারিয়েছে।

মলিকে এ কথা বলে প্রবোধ দেয়া গেল না।

আমাকে বলল, গত সপ্তাহে যে সাইকোপ্যাথ ধরা পড়লো, এমন কারো পাল্লায় যদি পড়ে?

কথাটা আমার বুকেও লাগলো, কারণ গাড়িতে আসতে আসতে আমি সেটাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু মলিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, পাগল নাকি? সাইকোপ্যাথ কি সপ্তায় সপ্তায় মেলে নাকি?

মলি আর আমি যতক্ষণে বনের রাস্তা ধরে ক্যাম্পিংয়ের জায়গাটায় পৌঁছালাম ততক্ষণে সার্চ পার্টি তাদের অভিযান শুরু করে দিয়েছে।

স্কুলের টিচার আন্দ্রেইর সাথে দেখা হল। মলি ওর দিকে এমন কড়া করে তাকালো যে আমারই ভীষণ লজ্জা লাগলো।

আন্দ্রেই বলল, পুলিশের পাশাপাশি আমাদেরও একটা দল অন্যপাশ দিয়ে খোঁজা শুরু করবে। তোমরা কি আমাদের সাথে যোগ দেবে।

এর উত্তর দেওয়াটাই অবান্তর মনে হল। আমরা গাড়ি থেকে গামবুট আর বড় টর্চলাইট নিয়ে রওনা হলাম দলটার সাথে।

সারাদিন খুঁজেও কোন হদিশ পাওয়া গেল না। আমার হৃৎপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে লাফাচ্ছে।

নিহান, বাবা তুই কই!

নিহানকে ছাড়া বন থেকে ফিরতে চাচ্ছিলো না মলি। কিছুটা জোর করেই ওকে নিয়ে গাড়িতে তুলি।

আমার ছেলেকে ছাড়া আমি যাব না এরিক। যাব না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সারাপথই ও বলল।

সার্চ তো থেমে নেই মলি। বোঝার চেষ্টা করো। অন্য আরেকদল সার্চ করবে এখন। আমরা আবার কাল সকালে আসবো।

ঠিক তিনদিনের মাথায় নিহানকে পাওয়া যায়।

বনের মাঝখানে একটা গাছের খোলের মধ্যে ও আশ্রয় নিয়ে ছিল শীত থেকে বাঁচতে। পুলিশের ড্রোন ওকে খুঁজে বের করে।

নিহানকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করার ব্যবস্থা করা হয়। আমি আর মলি হাসপাতালে ছুটে গিয়ে নিহানকে দেখতে পাই। আমরা সাথে সাথে ওর কাছে যেতে পারলাম না। ও দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো।

নিহান হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর একদিন আমরা গল্প করছিলাম। সেসময় নিহান অদ্ভুত এক কথা বলল,

বাবা, তোমরা কি ভাবছিলে যে আমি ওই সাইকোপ্যাথের মত কারো পাল্লায় পড়েছি?

হুম, ওই চিন্তা তো না চাইলেও চলে আসতো।

আচ্ছা, যে লোকটাকে সাইকোপ্যাথ বলছো তোমরা সে যদি আজ থেকে তিন চারশো বছর আগে জন্মাত তাহলে তাকে সেটা বলতে।

আমি হেসে বললাম, অবশ্যই না। শত শত বছর আগে মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী প্রায় প্রতিদিনই খেত। এমনকি কোন কোন জায়গায় নিজেরাই নিজেদের মাংস খেত।

ধরো, আমাদের যদি আধুনিক ফুড প্রসেসরগুলো না থাকতো, তাহলে কি আমরা এখনো অন্য প্রাণী খেতাম না?

অবশ্যই, তাই খেতে হত।

সাইকোপ্যাথ লোকটি নিদির্ষ্টভাবে ঠিক কি খেয়েছিল, জানো?

সেটা নিউজে ঠিকমতো বলেনি। তবে তার বাসন কুকার ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছে-পাখি জাতীয় কিছু।

তাহলে তোমরা এমন ব্যাক্তি নিয়ে ভয় পেলে কেন? যে পাখি খায়, সে কি আমাকে খাওয়ার কথাও চিন্তা করবে?

অবশ্যই, যে পাখি খায় সে গরু ছাগল কুকুর বিড়ালও খাবে, মানুষও খাবে। তাই তো হওয়ার কথা। একই তো ব্যাপার, সে অন্য একটি প্রাণী হত্যা করে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে।

বাবা, এটা তোমার ভুল ধারণা, দুই তিনশো বছর আগে কিন্তু অনেক বড় একটা অংশের মানুষ পাখি বা গরু ছাগল খেত, তারা কিন্তু অন্য মানুষদের খেত না।

হয়তো সুযোগ পেত না বলে খেত না। তাদের উদ্দেশ্য যদি হয় প্রাণীজ প্রোটিন, তাহলে সবই তো একই হওয়ার কথা!

নিহান বুঝাতে না পারার ব্যর্থতায় বিরক্ত হল মনে হল। দাঁড়িয়ে বলল, না বাবা, পাখি বা অন্য কোন প্রাণী খেলেই তোমরা সাইকোপ্যাথ ভাবো এটা ঠিক না, সব প্রাণীজ প্রোটিন হলেও সব প্রজাতি খাওয়ার ইচ্ছা একই মানুষের থাকবে সেটা সত্যি না।

তারপর একটু দম নিয়ে বলল, বনে হারিয়ে যাওয়া তিনদিন আমি ওখানকার খরগোশ, ছোট ছোট পাখি ইত্যাদি পুড়িয়ে খেয়ে বেঁচে ছিলাম।

কথাটা কতটা ভয়াবহ, নিহান যেন সেটা আঁচই করতে পারলো না। কী বলছে ছেলেটা!

আমি বিস্ময়াভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, খরগোশ খেয়েছো? পাখিও?

হ্যাঁ বাবা। এটাকে অত বড় করে দেখো না। আর তারমানে এই না, সুযোগ পেলে এখন আমি তোমাদেরও খাবো।

আমি বসা থেকে উঠে আস্তে আস্তে পিছিয়ে দরজার কাছে চলে যাই। সুযোগমত দরজাটা বন্ধ করে দিতে হবে।

নিহানও মনে হল আমার কথা বুঝতে পেরেছে। ও হতাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার কাছে যেতে দেখি পর্দার পেছনে মলি দাঁড়িয়ে, ওর হাতে ফোন। ফোনে পুলিশের জরুরী নাম্বারে ইতিমধ্যে ও ফোন দিয়ে দিয়েছে।

ছেলেটা কী ভীষণ অসুস্থ! এতদিন আমরা টের পাইনি।

~ গল্প: সাইকোপ্যাথ, ‘খরগোশকে মারো’ বইয়ে প্রকাশিত

Masudul Haque

Masudul Haque is a contemporary writer from Bangladesh known for his works on thrillers, Sci-Fi, and children's literature. His works have been published in Bangladesh and India regularly for the last 12 years. He was awarded the Kali O Kalam Young Writer Award in 2013.

One thought on “গল্প: সাইকোপ্যাথ

  1. গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হলো আসলেই টিভির সামনে বসে কোন মিনি সিরিজ দেখছি।
    শুরুটা একেবারে স্বাভাবিক। খাবার টেবিল, স্বামী-স্ত্রীর কথা সব পরিচিত লেগেছে।
    হঠাৎ নিহান হারিয়ে যাওয়ার পর যে আতঙ্ক তৈরি হলো, সেটা একেবারে বুক কাঁপানো।
    বনের ভেতর খোঁজার দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
    আবার খুঁজে পাওয়ার পর স্বস্তি এলেও শেষে যে মোড় নিল, সেটাই আসল চমক।
    নিহানের মুখে শোনা কথাগুলো খুবই কিছুটা স্বাভাবিক লাগলেও বেশিরভাগ অস্বস্তিকর, কিন্তু বাস্তব মনে হলো।
    মানুষ আসলে কোথায় গিয়ে থামবে, সেটা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে গল্পটা।
    লেখকের ভঙ্গিটা একেবারে সোজাসাপ্টা, তাই পড়তে কোনো জড়তা লাগেনি।
    গল্পটা ছোট হলেও ভিতরে ভয় আর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
    শেষ লাইনটা মনে গেঁথে যায় এ যেন শান্তির ভেতরে লুকানো কোন অশান্তি।

    এরকম আরো লেখা চাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *