মাশুদুল হক

হিমু ও মিসির আলীর হাতে কয়েকটি লাল পদ্ম

এআই ইতিমধ্যে খুব ভাল গদ্য লিখতে পারে। পদ্যও।

নন ফিকশন বই এর নব্বই ভাগই এআই দিয়ে লিখিয়ে ফেলা সম্ভব। ধরা যাক, কিভাবে পোষা প্রাণীর যত্ন নিতে হয় এমন একটা বই কেউ লিখবে, সেটা চ্যাটজিপিটি বা এই ধরনের যেকোন এআইকে দিয়ে কয়েক দিনেই খুব ভাল একটা বই লিখিয়ে নেয়া সম্ভব। এই ধরনের অনেক টপিক আছে, যেটা এখন আর কোন ব্যক্তির লেখার প্রয়োজনই নেই। স্টক মার্কেট, ফরেক্স, কোডিং শেখার বই, এসইও ইত্যাদি ইত্যাদি।

যেসব লেখা কোন ব্যক্তি-দ্বারা প্রভাবিত না, বা অবজেক্টিভ লেখা সেসবের জন্য ক্রমান্বয়ে উন্নত হওয়া এআই-ই যথেষ্ট। মানে ফরমায়েশি লেখকদের কাজ এখন কোন মানুষকে দিয়ে করানোর প্রয়োজন নাই।

তবে যে লেখার পেছনে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ, কে লিখছে গুরুত্বপূর্ণ সেটার ভবিষ্যত কি হবে সেটা একটা আলোচনার বিষয় হতে পারে।

ধরা যাক, একটা কাস্টম জিপিটি মডেল তৈরি করা হল, যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সমস্ত বই এর টেক্সট দেয়া হল, এবং হুমায়ূন আহমেদের মত নতুন একটা উপন্যাস লিখতে বলা হল হিমু আর মিসির আলীকে নিয়ে একই উপন্যাসে-তাহলে সেটা যা প্রডিউস করবে সেটা কতটা ভাল হবে? ধরা যাক কাস্টম জিপিটি যে উপন্যাস লিখেছে সেটার নাম ‘ হিমু ও মিসির আলীর হাতে কয়েকটি লাল পদ্ম’।

এই উপন্যাসটি নিয়ে যদি একটা টিম এক দুই সপ্তাহ সময় দেয় এবং এই মুহূর্তে এআই যে অবস্থায় আছে সেটার হায়েস্ট ইউটিলাইজেশন করে, তাহলে এই নতুন উপন্যাসের পাঠকের একটা অংশ হুমায়ূন আহমেদের অরিজিনাল কোন উপন্যাস থেকে এটা আলাদা করতে পারবে না। ধরা যাক, পাঠকদের এই অংশের বর্তমান পারসেন্টেজ ২০%। দিন যত যাবে, এআই তত উন্নত হবে, এবং এই পারসেন্টেজ তত বাড়তে থাকবে। মোটামুটি ৬০% এর উপরে সংখ্যাটা চলে গেলে প্রকাশকরা এটা বাজারে নিয়ে আসতে পারবে।

এখন হুমায়ূন আহমেদের মত করে এআই যত ভাল উপন্যাসই লিখুক পাঠক জানবে এটা এআই দিয়ে লিখিত, এবং পড়লেও সেটা মেনেই পড়বে।

কিন্তু ব্যাপারটা যদি কোন জীবিত লেখকের লেখা নিয়ে করা হয়?

এই ভয়টা এখন বুক ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। অলরেডি বিভিন্ন বইয়ের শুরুতে লেখা শুরু হয়েছে ‘ এই লেখকের কোন লেখা LLM কে ট্রেইন করার জন্য ব্যবহার করা যাবেনা।’

সেবা প্রকাশনীর মত প্রকাশনী যারা গোস্টরাইটারদের দিয়ে সিরিজ চালাতেন, তাদের জন্য ব্যাপারটা হয়তো সহজ হয়ে যাবে। তবে মানুষের মনে যখন এই সন্দেহ ঢুকে যাবে যে মেবি এটা এআই লিখিত তখন সেটার ফলাফল কি হবে সেটা আন্দাজ করতে আমাদের আরেকটু সময় লাগবে।

একটা কথা আছে, দুনিয়ায় যত নকল স্কচ হুইস্কি তৈরি হয়েছে ততই আসল স্কটিশ স্কচ এর দাম বেড়েছে। সে হিসেবে, যখন এআই টেক্সট এর জগতে সহজলভ্য হয়ে যাবে, তখন অরিজিনাল হিউম্যান স্ক্রিপ্ট এর দাম বাড়তে পারে। হয়তো, কিছুদিন পরে বইতে লেখাই থাকবে, এই বইয়ে কোন এআই এর সাহায্য নেয়া হয়নি এবং মানুষ লিখিত বইয়ের দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি হবে।

তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হবে, এটা যে এআই লিখিত না সেটা প্রমাণ করা। এআই যখন আর্ট/ইলাস্ট্রেশন দখল করে নিচ্ছিলো, তখন আর্টিস্টদের মধ্যে তাদের আর্ট প্রসেস শেয়ার করার হার বেড়ে গিয়েছিল এটা বোঝানোর জন্য তাদের আর্ট অরিজিনাল। এটা এখনো বিদ্যমান। কিন্তু লেখকদের সে উপায় নাই। তাই এআই আরেকটু উন্নত হওয়ার পর নতুন লেখকরা এই ঝামেলায় পড়বে।

যারা লেখক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, তাদের মধ্যে যদি কেউ অসৎ হয়-তারাও চাইলে নিজেদের টেক্সট দিয়ে এআইকে ট্রেইন করিয়ে অল্প শ্রম দিয়ে নতুন গল্প উপন্যাস ফিচার ইত্যাদি লিখিয়ে নিতে পারবে। এবং অসৎ লেখকের সংখ্যা কম নয়।

অনুবাদক হিসেবে নতুন কারো আসা খুবই কঠিন হবে, এমনকি খুব জনপ্রিয় হাতেগোনা কয়েকজন বাদে কারোরই আর প্রয়োজন পড়বে না।

একটা নতুন জনরা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে, এআই দিয়ে লিখিত ফিকশন/ননফিকশন। এই জনরা হয়তো ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হবে। প্রকাশনী ভেদে হয়তো সেসবেরও কোয়ালিটিতে পার্থক্য থাকবে।
হিমু ও মিসির আলীর হাতে কয়েকটি লাল পদ্ম কিংবা ফেলুদা ও শঙ্কুকে নিয়ে নতুন কোন কাজ আসলেই হয়তো একদিন বেস্টসেলার লিস্টে উঠতে শুরু করবে।

Masudul Haque

Masudul Haque is a contemporary writer from Bangladesh known for his works on thrillers, Sci-Fi, and children's literature. His works have been published in Bangladesh and India regularly for the last 12 years. He was awarded the Kali O Kalam Young Writer Award in 2013.

One thought on “হিমু ও মিসির আলীর হাতে কয়েকটি লাল পদ্ম

  1. এমন একটা লেখা পড়লাম, যা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে।
    এআই শুধু লেখে না, এখন লেখক আর পাঠকের ভেতরের সম্পর্ককেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
    “হিমু ও মিসির আলীর হাতে কয়েকটি লাল পদ্ম” কল্পনাটা পড়ে গা শিউরে উঠলো কারণ এটা অসম্ভবও নয় আর।
    লেখাটার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো বাস্তবতার সাথে ভয় মেশানো আজ যা ধারণা, কাল সেটাই বাস্তব হতে পারে।
    নকল স্কচ হুইস্কির তুলনা দারুণভাবে বোঝালো মানুষের তৈরি কাজের ভবিষ্যৎ মূল্য।
    কোন লেখা এআই-জেনারেটেড আর কোনটা মানুষের এটা প্রমাণ করা ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সংকট হতে পারে।
    গোস্টরাইটার, অনুবাদক, নতুন লেখক সবার জায়গা যেন ঝুঁকির মুখে।
    আবার, যারা অরিজিনাল থাকবে তাদের মূল্য হয়তো আগের চেয়ে অনেক বাড়বে।
    লেখাটার টোন গা ছমছমে হলেও বাস্তব আর নিরেট সত্য দিয়ে ভরপুর।
    পড়ে মনে হল বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন আলোচনা আমাদের এখনই শুরু করা উচিত না হলে কি যে হবে সেটা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *